‘ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধব, পাড়ার সমবয়সী আর দশটা ছেলের মতই আমি দৌড়ঝাঁপ করতাম, খেলতে গিয়ে হাত-পায়ে ব্যথা পেতাম, হাঁটু-কনুই ছিলে যেত। দুষ্টুমি-বাঁদরামি করতাম। বৃষ্টিতে ভিজতাম, কাদাপানিতে লাফালাফি করতাম। এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই আমার বেড়ে ওঠা। পুকুরে সাঁতরে বেড়ানোর যে আনন্দ তা সুইমিং পুলে হবে না। এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই একটি শিশু স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে।’
দেশের পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি মোঃ আশিকুর রহমান তুহিনের শৈশব ছিল এমনই রোমাঞ্চকর আর আনন্দের। তিনি দেশের স্বনামধন্য বায়িং হাউজ টেক্সওয়েভ লিমিটেড ও তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান মেসিস গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশ পোশাকশিল্প প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক।
এখনকার শিশুদের নিয়ে তাদের বাবা-মায়েরা বেশ দুঃশ্চিন্তা করেন। বাচ্চারা খায়না, পড়েনা, ঘুমায় না কিংবা খুব দুষ্টু আর চঞ্চল, সারাদিন টিভি দেখে- এমন অভিযোগ যেন বেশিরভাগ বাবা-মায়েদের নিত্যসঙ্গী। তাহলে কেমন ছিল আজকে যারা সফল, তাদের শৈশব।
আশিকুর রহমান তুহিন নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘একেক বয়সের একেকটি আলাদা আবেদন রয়েছে। আমি সেসব আবেদনে সাড়া দিয়েছি। পড়াশোনায় আমি যেমন খুব ভাল ছিলাম না, আবার খুব বাজে ছিলাম তাও না। বাবা-মায়ের খুব কড়া শাসনে বড় হইনি। তাই বলে আমাদের বকে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। গাছের ফল চুরি করে খাওয়ার বয়সে বন্ধুদের নিয়ে প্রতিবেশীদের গাছের ফল চুরি করেছি। হই হুল্লোড় করে বেড়িয়েছি। স্কুলে পড়াশোনায় ফাঁকিঝুকিও দিয়েছি।’
আমাদের লাল রংয়ের একটি গাভী ছিল। ওই গাভীটির যখন বাছুর হয় তখন পাড়া-প্রতিবেশীদের খুব ভিড় হয়েছিল। উপস্থিত সবার মধ্যে কেমন যেন একটা উৎসবমুখর আমেজ ছিল। উৎসাহ আর আনন্দ ছিল বেশ চোখে পড়ার মত। সে দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এমন নিখাদ আনন্দের অনেক ঘটনা ছিল আমাদের দিনগুলোতে।
তোরা জীবনেও মেট্রিক পাশ করতে পারবিনা
বিদ্যালয় জীবনের একটি ঘটনা প্রসঙ্গে আশিকুর রহমান তুহিন নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমার শৈশব কেটেছে ক্যান্টনমেন্টঘেঁষা ইব্রাহীমপুরে। পড়তাম মুসলিম মডার্ন স্কুলে। স্কুলে আমাদের ছয়-সাতজনের একটা সার্কেল ছিল। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম আমাদের ওপর খুব বিরক্ত ছিলেন। ম্যাডাম আমাদের প্রায়ই বেশ বকাঝকা করতেন। টেস্ট পরীক্ষার পর ম্যাডাম একদিন রেগেমেগে বললেন, তোরা জীবনেও মেট্রিক পাশ করতে পারবিনা। মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিন দেখা গেল, আমরা সবাই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি। শুধু তাই নয়, আমাদের সার্কেলের এক বন্ধু স্ট্যান্ড করল। স্কুলের ইতিহাসে সেটিই ছিল প্রথম স্ট্যান্ড করার ঘটনা।
যা পড়তাম, বুঝে পড়তাম
আমি পড়াশোনাটাকে সবসময়ই নিজের করে নিতাম (অউন করতাম)। যা পড়তাম, বুঝে পড়তাম। পড়াশোনায় পরিবারের কোন চাপ নিতে হয়নি আমাকে। যখন পড়তে বসতাম, পুরোটা শেষ না করে উঠতাম না। রাত যতই হোক, পড়া শেষ করা চাই। আব্বা-আম্মাকেও কখনও বলতে শুনিনি, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘুমোতে যা।’ উচ্চ মাধ্যমিকে তখন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের প্রতি সবারই একটা ঝোঁক ছিল। কলজের ইউনিফর্ম, কলেজের পরিবেশ সব মিলিয়ে আদমজীতে পড়তে পারা একটা বিরাট স্ট্যাটাসের ব্যাপার ছিল। কলেজে ভর্তি হবার পর আমি গ্রুপ স্টাডি খুব উপভোগ করতাম। খুব কাজে দিত গ্রুপ স্টাডি।
ওকে গ্রামে পাঠিয়ে দাও, চাষবাস করুক
উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষায় আমার ফল ভাল হয়নি, দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলাম। বাবা আমাকে শুনিয়ে মাকে বলছিলেন, ওকে গ্রামে পাঠিয়ে দাও, চাষবাস করুক। ওকে দিয়ে পড়াশোনা হবেনা। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন। সিদ্ধান্ত নিলাম ভাল কিছু আমাকে করে দেখাতে হবে। যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। এরপর নীলক্ষেতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি গাইড কিনলাম। পড়াশোনায় আটঘাট বেঁধে নেমে পড়লাম। অনেক শ্রম দিয়েছিলাম। ফলাফল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বিষয়ে ভর্তির সুযোগ। এরপরই বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এর মাঝে আমি আর বাবার সামনে যাইনি। এই যে পড়লাম, ঢাবিতে ভর্তির সুযোগ পেলাম- আমাকে কিন্তু কেউ কোন চাপে রাখেনি। মোটেও কোন বাধ্যবাধকতা ছিলনা। যতটুকু পড়েছি নিজের তাগিদেই পড়েছি।
যার ভাল বন্ধু নেই, তার জীবনে কিছুই নেই
আমি খুব বন্ধুপাগল মানুষ। আমার স্কুলের বন্ধুরা এখনো আমার ভাল বন্ধু। বন্ধুত্ব অমূল্য। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সখ্যতা, বন্ধুতার মাত্রা অন্যরকম। এই সম্পর্কের মাত্রা বলে বোঝানো যাবেনা। আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়েই রয়েছে বন্ধুদের অবস্থান।
আমার সবকিছুই পরিকল্পিত
আরেকটি অভ্যাস ছিল আমার। যেখানেই আমি আটকে যেতাম, সেখানেই আমি নতুন করে শুরু করতাম। একটা তাড়না কাজ করত, যে করেই হোক সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিতে ভাল লাগত। এখনো ব্যতিক্রম নই। আমার কোন কিছুই পরিকল্পনার বাইরে নয়। আমি যা কিছু করেছি, তা পরিকল্পনা করেই করেছি। এটি হয়ত অনেকের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। তবে আমার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। আমার সবকিছুই পরিকল্পিত।
ব্যক্তি আশিকুর রহমান তুহিন
আশিকুর রহমান তুহিনের জন্ম ১৯৭৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। নানার বাড়ি যশোরে। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। বাবা প্রয়াত হাফিজুর রহমান। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ি (ঠিকাদার)। মা সালেহা রহমান। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তুহিন সবার ছোট। তার শৈশব কেটেছে সেনানিবাস সংলগ্ন মিরপুরের ইব্রাহিমপুরে। মুসলিম মডার্ন স্কুল থেকে ১৯৮৯ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৯১ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক ও ১৯৯৭ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০০০ সালে তিনি কামরুন নাহারকে বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে আবরার আশিক ষ্ট্যাণ্ডার্ড ৬ ও আরিয়ান আশিক ষ্ট্যাণ্ডার্ড ১ এ স্কলাস্টিকায় পড়ছে। অবসর পেলে তুহিন গলফ খেলেন। সময় কাটান পরিবারের সঙ্গে। বেড়াতেও ভালবাসেন তিনি।
যেভাবে ব্যবসায়ি হয়ে উঠলেন
শৈশবে চঞ্চল আশিকুর রহমান তুহিন পড়াশোনার শেষ করার পর দুজন অংশীদার নিয়ে ১৯৯৮ সালে আশিকুর রহমান তুহিন বায়িং হাউজের (টেক্সওয়েভ) মাধ্যমে গার্মেন্টস ব্যবসায় আসেন। টেক্সওয়েভ যখন শুরু করি তখন আমাদের ছিল মাত্র দুজন স্টাফ- একজন মার্চেন্ডাইজার ও একজন পিয়ন। আর এখন স্টাফের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ জনে। এছাড়া আমাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এখন ৮০০। জার্মানি, নেদারল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছে আমাদের ৩০টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান (বায়ার)। প্রথম বছরে আমরা ৭ লাখ ইউনিট পোশাক তৈরির কার্যাদেশ পেয়েছিলাম। আর এখন বছরে আমাদের উৎপাদনের পরিমাণ ৩ কোটি ইউনিট। এসব পোশাকের মধ্যে রয়েছে সব ধরণের শার্ট, টিশার্ট, ডেনিমসহ বিভিন্ন ট্রাউজার, সোয়েটার, জ্যাকেট, লিনজারি, জুতা ইত্যাদি। প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছে আমাদের সঙ্গে। ২০০৮ সালে আমরা আইএসও সনদ লাভ করি।
তৈরি পোশাক শিল্পের আলোকিত মুখ আশিকুর রহমান তুহিন বিজিএমইএর পরিচালক। যুক্ত আছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। তিনি কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের সদস্য।