তিনি একজন নারী। পেশায় ব্যবসায়ি, প্যাশনে নারী সংগঠক। দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর উত্তরাধিকার নিয়ে তার উদ্যোগ, ভূমিকা প্রশংসনীয়। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে তার অনন্য কর্ম তাকে এগিয়ে এনেছে বহুদূর। যার কথা বলছিলাম, তিনি নেহরিন রহমান টুটলি। সবার কাছে তিনি টুটলি রহমান নামেই অধিক পরিচিত।
বহুমুখী গুণের মানুষ টুটলি রহমান জন্টা ক্লাব অব গ্রেটার ঢাকার চলতি মেয়াদের সভাপতি। দায়িত্ব পালন করছেন উইংস’র সভাপতি পদেও। ফ্যাশন ব্র্যান্ড বাই দেশী’র স্বত্বাধিকারী তিনি। ইন্টারন্যাশনাল উইভার্স ফেস্টিভ্যাল’র উদ্যোক্তা ও স্বত্ত্বাধিকারী। সম্প্রতি গড়ে তোলা বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। এমন অনেক পরিচয় কাঁধে নিয়ে আলো ছড়াচ্ছেন সফল এই নারী।
বাংলাদেশের ফ্যাশন খাতে তিনি প্রথম ফিউশন যুক্ত করে ফ্যাশনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প নিয়ে দেশে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক বুনন উৎসব আয়োজন করেন তিনি। একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন অনেকের অনুকরণীয় আদর্শ।
নতুনআলো টয়েন্টিফোর ডটকমের একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে টুটলি রহমানের জীবন ও কর্মের নানা অনুষঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈনূই জুয়েল।

টুটলি রহমানের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৫ মে, কুষ্টিয়া জেলা শহরে। তবে তার পৈত্রিক বাড়ি ফেনী জেলার রামনগর। বাবা প্রয়াত মোয়াজ্জেম হুসেন চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা নীলোফার হুসেন চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী, এখন অবসর যাপন করছেন।
মোয়াজ্জেম হুসেন চৌধুরী ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (ইপিআইডিসি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই পদে থাকাকালীন তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পরিবারে চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে টুটলি চতুর্থ। তার বড় ভাই প্রয়াত হয়েছেন। বাকি তিন ভাইদের মধ্যে দুই ভাই পেশায় চিকিৎসক, বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত।

বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ হয়েছে টুটলির। ১৯৭০ সালে ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে টুটলি মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৭২ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন তার বিয়ে হয়ে যায় ১৯৭৫ সালে।
টুটলির স্বামী রিয়াজুর রহমান একজন এফসিএ বা সনদধারী হিসাববিদ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট)। এছাড়া রিয়াজুর রহমানের পরিবারের রয়েছে চা বাগানের ব্যবসা। মৌলবিবাজারে তার নিজেরও রয়েছে চা বাগানের ব্যবসা- পাল্লাথাল টি এস্টেট।
বিয়ের পর টুটলি রহমান স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি জমান, বসবাস করেন চার বছর। তার প্রথম সন্তান সামিরের জন্ম সেখানেই।
স্বামীর সঙ্গে টুটলি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৮০ সালে। ওঠেন মগবাজারে, তার শ্বশুর বাড়িতে।

‘আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল। প্রচুর খোলা জায়গা ছিল। এ বাড়িতেই আমার ছোট ছেলের জন্ম। একা একা সারাক্ষণ বাসায় থাকতে ভাল লাগত না। বিদেশে থাকার সুবাদে ইংরেজি ভাষাটাও বেশ ভালোই রপ্ত করতে পেরেছিলাম। কিছু একটা করার তাগিদে আমি যোগ দিলাম গুলশানের মন্টেসরি স্কুলে। চার বছর শিক্ষকতা করলাম সেখানে।’
আন্তর্জাতিক চেইন হোটেল প্যান প্যাসিফিক বাংলাদেশে সোনারগাঁ হোটেল নামে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ১৯৮১ সালে।
শুরুটা জোয়ান ব্রুগেম্যানের সঙ্গে
টুটলি নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোনারগাঁ হোটেলের তৎকালীন ব্যবস্থাপক টমি ব্রুগেম্যানের স্ত্রী জোয়ান ব্রুগেম্যানের সাথে আমার পরিচয় হয়, সখ্যতা গড়ে ওঠে। জোয়ানের বন্ধু ছিল মরিন বারলিন। জোয়ান নতুন ধরণের একটি কাজের প্রস্তাব দেন আমাকে। আমিও রাজি হই। এটি ১৯৮০ সালের দিকের ঘটনা। জোয়ান, মরিন ও আমি- আমরা তিনজন মিলে ‘জেটিএম কন্সালট্যান্টস’ নামে শুরু করলাম নতুন ধারার একটি ব্যবসা।
‘বাংলাদেশে যেসব বিদেশি অতিথি আসতেন, তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতাম আমরা। তাদের জন্য বাসা খুঁজে দেয়া, বাসার ইন্টেরিয়র নকশা, আসবাব সেটআপ করে বাসাকে বসবাসের উপযোগী করে দেয়াই ছিল আমাদের কাজ। এতে সার্ভিস খরচ বাবদ আমরা পেতাম বাসা ভাড়ার ১০ শতাংশ ও অন্যান্য কাজের বিপরীতে পেতাম ১০ শতাংশ।’

জেটিএম কন্সালট্যান্টস ছিল টুটলি রহমানের প্রথম ব্যবসা।
‘মরিন পরে কানাডায় চলে যায়। জোয়ান আর আমি এ ব্যবসা চালিয়েছি প্রায় ছয় বছর। জোয়ান ব্রুগেম্যান বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পর আমি এককভাবে এ ব্যবসা আর না চালানোর সিদ্ধান্ত নিই।’
টুটলি বলেন, জোয়ান ব্রুগেম্যান তার কাজে খুবই পেশাদার ছিলেন। তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ব্যবসায় আমি তাকে আমার গুরু বলে মানি।
পরবর্তীতে টুটলি রহমান প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলের প্ল্যান্ট ল্যান্ডস্কেপিংয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
‘আমার ননাস (স্বামীর বড় বোন) ফাইজা হোসেন। তার স্বামীর চাকরির সুবাদে তারা সপরিবারে হংকং বদলি হয়। বিদেশে যাওয়ার সময় ফায়জা আপা টবে লাগানো তার প্রায় দেড়শ চারা গাছ আমাকে দিয়ে যান। আমিও আগ্রহ নিয়ে চারাগাছগুলো রাখলাম। তিন-চার বছরে এই চারা গাছের সংখ্যা আমি প্রায় দ্বিগুণ করে ফেললাম।’

টুটলি রহমান বলেন, আমার বড় ভাই (মনোয়ার হোসেন) কর্মরত ছিলেন বিসিসিআইয়ে (ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল; বর্তমান ইবিএল)। তিনি এত গাছ দেখে তার ব্যাংকের সাজসজ্জার জন্য চারাগাছ চাইলেন। তিনি এও জানালেন, টবসমেত চারাগাছ ভাড়াও দেয়া যায়। শুরুতে ব্যাপারটি শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। সে সময় আমি তাকে ১০০টি চারাগাছ দিয়েছিলাম, বিপরীতে পেয়েছিলাম ৩০ হাজার টাকা। এরপর আমার স্বামীর এক বন্ধুর সুবাধে গ্রিন্ডলেস ব্যাংকে চারাগাছ দিয়েছিলাম।
সে সময় বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ব্যাংকগুলো তাদের ল্যান্ডস্কেপিংয়ের জন্য চারা গাছ ভাড়া নিত। আর এই সেবা মূলত বিভিন্ন নার্সারি মালিকরা দিতেন। তবে হাতে গোনা কয়েকজন যুক্ত ছিলেন এই ব্যবসার সঙ্গে।
টুটলি রহমান শখের বশে শুরু করলেও, পরবর্তীতে তিনি এই ব্যবসায় পেশাদারিত্ব আর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখেন। চারাগাছের সঙ্গে থাকা মাটির টবকে তিনি আরও পরিপাটি ও বর্ণীল করে তুলেছিলেন, সঙ্গে যোগ করেন রঙে আঁকা বাহারী নকশার ব্যবহার। এর মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয় টুটলি রহমানের আরেকটি ব্যবসার- পটার্স হাট। পাত্র, টব, ফুলদানিসহ মাটির নানা জিনিস নিয়ে তার এ ব্যবসাও আলোর মুখ দেখে। পটার্স হাট নামে এ ব্যবসা প্রায় ১০ বছর চালিয়েছেন তিনি।

দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায় টুটলি রহমানের শৈল্পিক এসব কাজ। এর সুবাদে চারাগাছ ভাড়া দেয়ার এই ব্যবসার খাতটিতে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য ও পথিকৃৎ।
‘এভাবে ১৯৯০ সালের দিকে আমার চারাগাছ ভাড়া দেয়ার ব্যবসার (ইনডোর প্ল্যান্ট রেন্টাল সার্ভিস) সূত্রপাত। সেই থেকে চলছে এখনও। সে সময় প্রায় সব ব্যাংকেই আমার দেয়া চারাগাছ ছিল। আস্তে আস্তে অনেক কর্পোরেট কোম্পানিও আমার চারাগাছ নিতে থাকল।’
দেশের প্রায় সব ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সে সময় আমার গ্রাহক ছিল, জানান টুটলি রহমান।
রট আয়রনের আসবাবের ব্যবসাতেও তিনি সাফল্য পেয়েছেন। এ ব্যবসায়ও তিনি তার সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার এই আসবাব ব্যবসার দোকানের নাম ছিল এক্সপ্রেশন্স। প্রায় ৮ বছর তিনি এ ব্যবসা চালিয়েছেন।

তার এই ব্যবসাগুলো তিনি সমসাময়িক সময়ে চালিয়েছেন।
ফিউশন শাড়ি ও ফ্যাশনে নতুন মাত্রা
২০০৫ সালে টুটলি রহমান ফ্যাশন নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। তার ফ্যাশন ব্র্যান্ডের নাম ‘বাই দেশী’।
‘বাই দেশী’র সব পোশাক আমার নিজের নকশায় ও তত্ত্বাবধানে তৈরি। আমার প্রধান পণ্য শাড়ি ও মেয়েদের পোশাক । যদিও এটিকে আমি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করি না।’
ঘরোয়া পরিসরে চেনা-পরিচিত মানুষেরাই বাই দেশী’র প্রধান গ্রাহক। এছাড়া বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পোশাক গ্রাহকদের কাছে পৌঁছায়। তবে ২০০৪ সালে জন্টা ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে তিনি তার নকশা করা পোশাক নিয়ে ফ্যাশন শো’র আয়োজন করেন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলকভাবে ফিউশন শাড়ির সূত্রপাত করেন। এই শাড়ি তাকে ফ্যাশন অঙ্গনে পরিচিত এনে দেয়। এ ধারাবাহিকতা নিয়ে তিনি তার ফ্যাশন কর্মকাণ্ডে আরও নৈপুণ্য ও সৃজনশীলতা যুক্ত করে ফ্যাশনকে সমৃদ্ধ করেছেন।

বাই দেশী’র বিয়ের ও ক্যাজুয়াল পোশাক নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার ফিউশন ফ্যাশন শো’র আয়োজন করেন, যা তাকে গুণী ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়।
ফোকফেস্ট আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল
ইভেন্ট পরিকল্পনায়ও টুটলি রহমানের রয়েছে অসামান্য অর্জন। তিনি ২০১৫ সালে স্কয়ার গ্রুপ আয়োজিত প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টিভ্যালের ইভেন্ট পরিকল্পনাকার ছিলেন।
২০১৬ সালে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প নিয়ে দেশে প্রথমবারের আন্তর্জাতিক বুনন উৎসব আয়োজন করে আলোচিত হন তিনি। ‘ইন্টারন্যাশনাল উইভার্স ফেস্টিভ্যাল’ নামে এ অনুষ্ঠানটির স্বত্ত্ব তার নামেই নিবন্ধিত।

এর আগে আহসান মঞ্জিলে ২০০৭ সালে ‘আ জার্নি টু নকশিকাঁথা’, লালবাগ কেল্লায় ২০০৯ সালে ‘ইভলিউশন অব শাড়ি’ অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজক ছিলেন টুটলি রহমান।
সম্প্রতি টুটলি রহমান শুরু করেছেন বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ। এর নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে। নিবন্ধন শেষ হলে এর কার্যক্রম শুরু হবে। এ ফাউন্ডেশন বুনন শিল্প, হস্তশিল্পসহ দেশের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রসার নিয়ে কাজ করবে, জানান টুটলি রহমান।
পারস্পরিক সহযোগিতার উইংস
নেহরিন রহমান টুটলি ২০১৫ সালে বিভিন্ন পেশাজীবী ও উদ্যোক্তা নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সংগঠন- উইংস (উইমেন ইন সাপোর্ট গ্রুপ)। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য মূলত- সংগঠনের সব সদস্যদের পারস্পরিক প্রয়োজনে নানা পরামর্শ, সহযোগিতা করা। নানা পেশার নারীরা যুক্ত আছেন উইংস’র সদস্য হিসেবে। সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, নারী উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী নারী। সংগঠনটির শুরু থেকে টুটলি রহমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

প্রতি বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের পুরস্কার ও সম্মাননা দিয়ে আসছে সংগঠনটি। মেধাবী ছাত্রীদের দেয়া হয় সম্মাননা।
উইংস নামে সংগঠনটির রয়েছে একটি ইংরেজি সাময়িকী প্রকাশনা।
অপছন্দের শব্দ ‘আহারে!’
হস্তশিল্প, কারুশিল্প, ফ্যাশন শিল্প, তাঁত শিল্প- এসব আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি বহন করে। শিল্পের এ খাতগুলো আজ বিলীন হবার পথে। এর অন্যতম কারণ- যারা এসব শিল্প কর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, তারা তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। এসব পেশার কারিগররা অর্থের অভাবে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। আবার তাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে অন্যান্য উদ্যোক্তাদের অনেকেই আলোর মুখ দেখছেন। কিন্তু মূল কারিগরদের দিন কাটছে অর্থাভাবে, খেয়ে না খেয়ে। আমি মূলত সেসব প্রকৃত কারিগরদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তাদের জীবনমান বদলাতে চাই। তাদের আর্থিক স্বাবলম্বীতার জন্য আমি কিছু পদক্ষেপের ব্যাপারে ভেবেছি। অচিরেই সেগুলো নিয়ে কাজ করব।

এক প্রসঙ্গে টুটলি বলেন, ‘আহারে!’- এই আফসোস প্রকাশক শব্দটি আমার মোটেও পছন্দের নয়। আমার জীবনে যথেষ্ট প্রাপ্তি আছে। অনেক পেয়েছি, এবার দেবার পালা।
আমরা যারা সমাজে নিজ নিজ অবস্থানে ভাল আছি, তারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এলে সমাজের চেহারা বদলে যাবে। আমাদের সবাইকে এ দায়িত্ব নিতে হবে।
চার দেয়ালের ভেতরে ফ্যাশন শোতে দর্শক ক্লান্ত
‘আমি আসলে আমাদের হেরিটেজ স্থানগুলোতে কিছু ফ্যাশন শো’র আয়োজন করতে চাই। কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে তো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফ্যাশনের বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থাপন নিয়ে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মানুষ চার দেয়াল ঘেরা পরিসরে ফ্যাশন শো দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আমি এ ক্লান্তিটা আর বাড়াতে চাই না।’

২০১৩ সালে নেহরিন রহমান গড়ে তোলেন জন্টা ক্লাব অব গ্রেটার ঢাকা। ২০১৮-২০ মেয়াদে নেহরিন রহমান টুটলি জন্টা ক্লাব অব গ্রেটার ঢাকার সভাপতি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশে এটি জন্টা ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ ক্লাব। এর আগে তিনি যুক্ত ছিলেন জন্টা ঢাকা ১ ও ৫ ক্লাবের সঙ্গে।
জন্টা ইন্টারন্যাশনাল একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে এ সংস্থাটি। তবে এ সংগঠনটি কাউকে সরাসরি কোন কিছু দান করে না, বরং সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বনির্ভর করে তোলে।

মাদকের বিরুদ্ধে আলো
২০০২ সালে মাদক সচেতনতা কর্মসূচীর সূত্রপাত করেছিলেন টুটলি রহমান। তার ওই কর্মসূচীর নাম ছিল ‘আলো’। এ কর্মসূচী থেকে তিনি মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে নানা রকম প্রচারণার আয়োজন করেছেন।
উত্তরা ক্লাব ২০১৩ সালে নেহরিন রহমান টুটলিকে পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৬ সালে তাকে বর্ষসেরা উদ্যোক্তার স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করে ডাব্লিউইএ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। একই বছর তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে বর্ষা সুন্দরী পুরস্কার লাভ করেন কোলকাতা থেকে। ওই বছর জেসিআই নামে একটি প্রতিষ্ঠান নেহরিন রহমানকে উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার দেয়। অনুপ্রেরণার সাহসী নারী হিসেবে তিনি ২০১৭ সালে একটি পুরস্কার লাভ করেন।
এক প্রসঙ্গে টুটলি রহমান বলেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার কোন সম্ভবনা নেই আমার। যারা অভিজ্ঞ, ভাল বোঝেন রাজনীতি তাদের কাছেই নিরাপদ। আমি আমার কাজের পরিসরেই থাকতে চাই। দেশের অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে আমার মেশার সুযোগ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অনেক চেষ্টা করছেন। তার দলীয় নেতারাও ভূমিকা রাখছেন।

টিভি উপস্থাপনা উপভোগ করি
মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে ‘টি উইথ টুটলি’ নামে একটি টেলিভিশন টক শো’র সঞ্চালনা করেছেন তিনি। প্রচারিত হয়েছে ৬৫টি পর্ব। বর্তমানে এনটিভিতে তার উপস্থাপনায় প্রচারিত হচ্ছে টেলিভিশন টক শো ‘টুটলির তাজা চায়ের আড্ডা’।
‘টিভি উপস্থাপনের কাজটা আমি বেশ উপভোগ করি।’
চমৎকার মানুষ, ভাল স্বামী
‘মানুষ হিসেবে চমৎকার। স্বামী হিসেবে ভাল। কথা কম বলে। আমার কোন কাজে তার ‘না’ ছিলনা। কখনো নিরুৎসাহিত করেনা। ও কখনোই কোন ঝামেলা করে না। চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। ভাবি, ও আরেকটু ফানলাভিং হতে পারত। আমারও আরেকটু ভাল লাগত। আমার কাজে ও সবসময় পাশে থেকেছে। আমার যা কিছু অর্জন, প্রাপ্তি, পরিচিত- সবই হয়েছে বিয়ের পরে।’ স্বামী রিয়াজুর রহমান সম্পর্কে নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এমন অভিব্যক্তি জানালেন টুটলি রহমান।
টুটলি রহমানের দুই ছেলে। বড় ছেলে সামির আসরান রহমান, পেশায় একজন অ্যানিমেশন ডিজাইনার। ছোট ছেলে ওসাঈদ শাহান রহমান পেশায় প্রকৌশলী সামিরের স্ত্রী ফারিয়া রহমান। তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কর্মরত আছেন সাজেদা ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে। শাহানের স্ত্রী ইজমা রহমান ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে তিনি সার্টিফায়েড প্রফেশনাল অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সিপিএ) বিষয়ে পড়ছেন।

টুটলি রহমান দুই পুত্রবধূ প্রসঙ্গে বলেন, ওরা ভীষণ আন্তরিক। পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল। দে আর জাস্ট মাই ডটার। আই লাভ দেম সো মাচ। অ্যান্ড আই অ্যাম সো হ্যাপি উইথ দেম।
টুটলি রহমান সপরিবারে রাজধানীর বসুন্ধরায় বসবাস করছেন।
আমার সব শাড়ি নিজের ডিজাইন করা
নেহরিন রহমান টুটলির প্রতিদিনের জীবনযাপন প্রসঙ্গে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম ভাঙ্গে টুটলি রহমানের। সাড়ে ৭টায় তিনি নাশতা করেন। নাশতায় তিনি সাধারণত চা, বিস্কুট, ডিম, পরোটা ও পনির খান। এরপর তিনি আধঘণ্টা খবরের কাগজ পড়েন। তারপর তিনি কিছু সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকে সময় কাটান। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তিনি তার পেশাগত দাপ্তরিক কাজ শুরু করেন। দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে দুপুরের খাবার সেরে ফেলেন। এরপর তিনি কিছু সময় টিভি দেখেন। আবারও তার পেশাগত কাজে সময় দেন। ৯টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করেন। এরপর তার সময় কাটে টিভি দেখে। তিনি টিভি সিরিজ দেখতে বেশ পছন্দ করেন। ১২টার আগে সাধারণত তিনি ঘুমান না।
‘আমার পছন্দের পোশাক শাড়ি। আমার সব শাড়ি নিজের ডিজাইন করা। খেতে পছন্দ করি দেশী খাবার। প্রিয় ভ্রমণস্থান ইতালি। প্রিয় রং সাদা।’

একটি অপরাধবোধ ও সরল স্বীকারোক্তি
টুটলি রহমানের মা নীলোফার হুসেন চৌধুরী। বয়সজনিত কারণে তিনি ঘরোয়া জীবনযাপন করছেন। স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটে তার। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে শয্যাশায়ী থেকে।
‘মা কানে কম শোনেন। অনেক ক্ষেত্রেই একই কথা বার বার বলেন। কথা বলার সময় কখনো কখনো বিরক্ত হয়ে যাই। কখনো খানিকটা রেগেও যাই। এর পরক্ষণেই মনে হয়- আমার এই রেগে যাওয়া, অনুবিরক্তি অবশ্যই ঠিক নয়। একটা অপরাধবোধ কাজ করে নিজের ভেতরেই। তখন নিজেকে আবার শোধরে নিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করি।'

টুটলি রহমান বলেন, আজকে আমার যে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও অর্জন, প্রাপ্তি- তা আমি পেয়েছি আমার মায়ের কাছ থেকে। মা নিজ হাতে আমাদের ভাইবোনদের কত পোশাক সেলাই করে দিয়েছেন- তার হিসেব নেই। আমরা সব ভাইবোন আজ নিজ নিজ অবস্থানে ভাল আছি।