নাছির ইউ মাহমুদ। দেশের অন্যতম সফল আবাসন ব্যবসায়ি। কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। সম্প্রতি নতুন আলো টয়েন্টিফোর ডটকমের একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার ব্যবসা, রাজনীতিসহ কর্ম ও ব্যক্তিজীবনের নানা অনুষঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈনূই জুয়েল।
তিনি ৩৭ বছর ধরে নির্মাণ ও আবাসন ব্যবসায় আছেন। ১৩ বছর ধরে কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। আবাসন ব্যবসার আগে তিনি মাহমুদ ব্রাদার্স নামে ঠিকাদারি নির্মাণ ব্যবসা শুরু করেন।

আবাসন ব্যবসায়িদের নিয়ে রিহ্যাব কার্যত নিষ্ক্রিয়
চলমান করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে দেশের আবাসন খাত নিয়ে ব্যবসায়িদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কেউ বলছেন ব্যবসা ভালো যাচ্ছে, কেউ বলছেন মন্দ। এ প্রসঙ্গে নাছির ইউ মাহমুদ নতুন আলোকে বলেন, দেশের করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে আবাসন খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফ্ল্যাটের বিক্রি কমে গেছে। যারা কিস্তিতে ফ্ল্যাট কিনছেন, তাদের ৯০ শতাংশ মানুষ ফ্ল্যাটের কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে নিয়মিত আর্থিক লেনদেন বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে। অথচ আমাদেরকে বসিয়ে বসিয়ে স্টাফদের বেতন দিতে হয়েছে। সাম্প্রতিক লকডাউন, শাটডাউনে নির্মাণ কাজও বন্ধ ছিলো। সব মিলিয়ে আবাসন খাত ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
সম্প্রতি আবাসন ব্যবসায়িদের সংগঠন রিহ্যাবের নতুন কমিটি হয়েছে। আগের মেয়াদের সভাপতি নতুন মেয়াদেও সভাপতি হয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদে নতুন পুরনো নেতৃত্ব আছেন।
আবাসন ব্যবসায়িদের উন্নয়নে রিহ্যাবের ভূমিকাকে কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে নাছির ইউ মাহমুদ নতুন আলোকে বলেন, আবাসন ব্যবসায়িদের নিয়ে রিহ্যাবের কোন মাথাব্যাথা নেই। আগেও খুব একটা ছিল- এমন নজির নেই। কারা কমিটিতে থাকছেন, কিভাবে থাকছেন, এগুলো সরকার আর সংশ্লিষ্ট বড় নেতারাই জানেন। জমির মালিকের কাছ থেকে জমি নেবার পর ভবনের নকশা অনুমোদনে রাজউকের অনর্থক দীর্ঘসুত্রিতা, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের হয়রানি, ভুমি অফিসের হয়রানি মোটেও কমেনি। এদিকে লাগামহীনভাবে বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। এসব জটিল আর বড় ইস্যু নিয়ে রিহ্যাব নেতাদের মাথা ঘামানোর সময়, সুযোগ নেই। দেশের আবাসন কোম্পানির সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা নিয়ে রিহ্যাবের তেমন কোন ভূমিকা নেই। আবাসন ব্যবসায়িদের নিয়ে রিহ্যাবের কার্যত সক্রিয়, ব্যবসাবান্ধব কোন সক্রিয়তা নেই।

নাছির ইউ মাহমুদ আরও বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) আবাসন খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ লাখের বেশি মানুষ সম্পৃক্ত। সব মিলিয়ে ২৪০টি ছোট-বড় খাত (লিংকেজ শিল্প) আবাসনের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে বড় খাতগুলো হলো রড, স্টিল, সিমেন্ট, ইট, রং, গ্লাস, সিরামিকস, টাইলস, ইলেকট্রিক পণ্য। এ সবই দেশীয় পণ্য। দেশীয় পণ্যের ওপরেই পুরো নির্মাণ খাত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সরকারে কাছে আবাসন খাতটি অনেকটা অবহেলিত রয়ে গেছে। তৈরি পোশাক খাতকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরণের সুবিধা দেওয়া হলেও আবাসন খাত যথাযোগ্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। এটি বড় ধরণের বৈষম্য। রিহ্যাব নেতারা এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নজর দিতে পারেন, সরকারের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
দেশে এখন রাজনীতি নেই
ছাত্রজীবন থেকেই নাছির ইউ মাহমুদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৭৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ডাকসুর নির্বাচিত ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮২ সালে এসএম হলের ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’র আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন থেকেই তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় পার্টির অবস্থান প্রসঙ্গে নাছির ইউ মাহমুদ নতুন আলোকে বলেন, এই মূহুর্তে দেশে রাজনীতি নেই। সরকারি দলের বিরাগভাজন হয়ে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে মাঠে নামতে পারছে না। নির্বাচনে সক্রিয় থাকছে না। ফলে জাতীয় পার্টির অবস্থান অপেক্ষাকৃত ভালো। দেশে আকস্মাৎ বড় ধরণের কোন পরিবর্তন না হলে, আগামীতে জাতীয় পার্টি আরো এগিয়ে যাবে। সংসদে আসন সংখ্যা বাড়বে।
নব আদর্শ প্রাইমারি স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাছির ইউ মাহমুদের জন্ম ১৯৬১ সালের ২ মে বরিশাল সদরে। বাবা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ। পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে পুলিশ সুপার পদে থাকাকালীন তিনি অবসরে যান। মা জেবুন্নেসা বেগম। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে নাছির মাহমুদ দ্বিতীয়।

নাছির ইউ মাহমুদের পড়াশোনার হাতেখড়ি বরিশাল শহরের নব আদর্শ প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭৫ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭৭ সালে বিএম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
কখনো চাকরিজীবী হতে চাইনি
১৯৮৩ সালে মাহমুদ ব্রাদার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। শিক্ষাভবন, দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় সৌদি আরবের অর্থায়নে নির্মিত ৩৫টি সাইক্লোন সেন্টার এ প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত হয়েছে, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক নির্মাণ কাজ, পিলখানা বিজিবি সদর দপ্তরের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য অবকাঠামো নির্মাণ কাজ এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকেই করা হয়েছে, জানান তিনি।
এক প্রশ্নের উত্তরে নাছির ইউ মাহমুদ বলেন, কখনো চাকরিজীবী হতে চাইনি। নিজের একটি স্বকীয় পরিচয় তৈরি করতে চেয়েছি।
২০১০ সালে ‘মাহমুদ ব্রাদার্স’ নাম বদলে ‘ওরিয়েন্ট ট্রেডিং এন্ড বিল্ডার্স লিমিটেড’ রাখা হয়। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে এবং এমএস আলম ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন। এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারের গণপূর্ত অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি), রাজউক, রেলওয়েসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের অসংখ্য সেতু ও সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছে।
বর্তমানে সেতু কালভার্ট নির্মাণ কাজ বেশি করছি। আমরা ইতোমধ্যে ‘ব্রিজ এক্সপার্ট’ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছি, উল্লেখ করেন নাছির মাহমুদ।

নাছির ইউ মাহমুদ ২০০৮ সালে কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেড নামে আবাসন ব্যবসা শুরু করেন। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের সম্পন্ন প্রকল্প ২৫টির বেশি। চলমান প্রকল্প আছে ৮টি। ৪টি নতুন প্রকল্প শুরু হবার অপেক্ষায়।
প্রতিষ্ঠানের ল্যান্ডমার্ক প্রকল্প প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাছির ইউ মাহমুদ বলেন, উওরায় অবস্থিত আরএস কুঞ্জ আমাদের ল্যান্ডমার্ক প্রকল্প। মিরপুরের পল্লবীতে আমাদের একটি বিশেষায়িত প্রকল্প চলছে। মিরপুরে এ ধরণের আবাসিক ভবন আগে হয়নি। আমাদের ভবনের তিন দিকে রাস্তা রয়েছে। নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলা আমরা উন্মুক্ত রেখেছি। মিরপুরে আমাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বড় প্রকল্প কালশী কুঞ্জ। এটি ১৪ তলা ভবন।
তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ মিরপুরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। আমরা দেখছি মিরপুরে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে আমরাও মিপুরের বেশ কিছু ভবন নির্মাণ করেছি। চলমান প্রকল্পও আছে কয়েকটি।
ব্যবসায়ে সাফল্য ব্যবসার সঠিক ব্যবস্থাপনায়
নতুন যারা আবাসন ব্যবসায় আসতে চান তাদের উদ্দেশ্যে নাছির ইউ মাহমুদ বলেন, বড় বিনিয়োগ, দূরদর্শিতা, সর্বোপরি ব্যবসার ব্যবস্থাপনা জানতে হবে। আবাসন ব্যবসায় এখন অনেক প্রতিযোগিতা বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে, যে পরিমান জমি আছে তার চেয়ে আবাসন কোম্পানির সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। ব্যবসা শুরু করার আগে, ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে নাছির ইউ মাহমুদ বলেন, যিনি বা যারা আবাসন ব্যবসা শুরু করবেন, তাদেরকে প্রকৌশলী বা স্থপতি হতে হবে- এমন বাধ্যতা নেই। এবং এটি জরুরীও নয়। ব্যবসা টিকে থাকে, এগিয়ে যায় মুলত ব্যবসার সঠিক ব্যবস্থাপনার উপরে। সুতরাং টেকনিক্যাল ক্যাপাবিলিটি নয়, বরং ম্যানেজারিয়াল ক্যাপাবিলিটি হচ্ছে ব্যবসায় সাফল্যের মূলমন্ত্র।
আগামী ১০ বছরে কুঞ্জ ডেভেলপার্সকে কোথায় দেখতে চান এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেশের সেরা পাঁচ আবাসন কোম্পানির একটি হতে চাই। আগামীতে আমরা কন্ডমোনিয়াম ভবন, ল্যান্ড প্রকল্প নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করছি।
নিজের আবাসন কোম্পানির বাইরে তার পছন্দের আবাসন কোম্পানি শান্তা প্রপার্টিজ, এমপোরি, অ্যাশিওর গ্রুপ, এবিসি রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, বিটিআই।

নাছির ইউ মাহমুদ ১৯৮৩ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী নিলুফা মাহমুদ। তাদের দুই ছেলে। বড় ছেলে সালমান মাহমুদ। তিনি কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ছোট ছেলে মাহমুদ আনজুম। সুইডেনের লুন্ডি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সেখানেই বসবাস করছেন তিনি। সুইডেনে চাকরির পাশাপাশি রেস্তোরাঁ ব্যবসা রয়েছে তার।
নাছির ইউ মাহমুদ উত্তরা ক্লাবের ২০১৫-২০১৭ পর্যন্ত তিন মেয়াদে সভাপতি ছিলেন। তিনি ঢাকা বোট ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম সিনিয়র্স ক্লাব, বরিশাল ক্লাব,সিলেট ক্লাব, অল কমিউনিটি ক্লাব, বনানী ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি ক্লাবের সদস্য তিনি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক নির্বাহী পরিষদের সদস্য। যুক্ত আছেন লায়ন্স ক্লাবের সঙ্গে। লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ এ-২ এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
সপরিবারে নাছির ইউ মাহমুদ রাজধানীর উত্তরায় বসবাস করেন।