নীলোফার খন্দকার। দেশের একজন প্রথিতযশা রূপ বিশেষজ্ঞ। নব্বইয়ের দশকে যাদের হাত ধরে দেশের রূপচর্চা শিল্প এগিয়েছে, ভিন্নতা পেয়েছে, সেসব মুষ্টিমেয় নারী উদ্যোক্তার একজন তিনি। দেশে ৩২ বছর, বিদেশে ১৮ বছর মিলিয়ে পাঁচ দশক ধরে রূপচর্চা শিল্পে তার দীর্ঘ যাত্রা। জীবন ও কর্মময় এ পথচলা নিয়ে তাঁর রয়েছে নানান অভিজ্ঞতা; কৌতূহল উদ্দীপক গল্প। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ও অভিজাত রূপচর্চা সেবাকেন্দ্র নীলো’স বিউটি স্যালনের সত্ত্বাধিকারী তিনি।
নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমের একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নীলোফার খন্দকারের শৈশব, শিক্ষা, কর্ম ও ব্যক্তিজীবনের নানা অনুষঙ্গ।
| নিজ স্যালনে নীলোফার খন্দকার। ছবি: নতুন আলো
বিএসওএবি'র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নীলোফার খন্দকার
সম্প্রতি (২৪ মার্চ ২০২২) বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএসওএবি)’-এর নতুন কমিটি গঠিত হল। বিএসওএবি’র ২০২১-২০২৩ মেয়াদের নব নির্বাচিত ১৬ সদস্যের কার্যনির্বাহী প্যানেলের সভাপতি কানিজ আলমাস খান ও সিনিয়র সহ-সভাপতি নিলোফার খন্দকার।
প্যানেলে আরও আছেন- সহ-সভাপতি গীতি বিল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক সুমনা হাসান, সহ-সাধারণ সম্পাদক আলেয়া শারমিন কচি, উপ-সাধারণ সম্পাদক আরিফা হোসেন, কোষাধ্যক্ষ সায়রা মঈন, যুগ্ম কোষাধ্যক্ষ রাজিয়া সুলতানা, সম্পাদক- জনসংযোগ, যোগাযোগ ও ইভেন্ট কাজী কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক- জনসংযোগ, যোগাযোগ ও ইভেন্ট রহিমা সুলতানা রীতা ও ফারখুন্দা জাবীন খান (সঙ্গীতা খান), দপ্তর সম্পাদক ফারহানা ইয়াসমিন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক রোজা হোসেন, যুগ্ম সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোসাঃ ইসরাত জাহান, সদস্য ইসি- সায়লা ইসলাম ফ্লোরা ও কানিজ সুলতানা।
সংগঠনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে নীলোফার খন্দকার নতুন আলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমাদের অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমরা নানা রকম উদ্যোগ নিচ্ছি। বিদেশী রূপ বিশেষজ্ঞ এনে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। আরও কার্যকর ও উদ্যোক্তাবান্ধব নানা কর্মসূচী আমরা গ্রহণ করবো। উন্নত প্রশিক্ষণই উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে পারে। তাই আমাদের অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমরা সময়োপযোগী নানা কার্যক্রমের উদ্যোগ নিচ্ছি।
| বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর মিটিংয়ে নীলোফার খন্দকার। ছবি: সংগৃহীত
এখন পর্যন্ত আপনাদের সদস্য সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সদস্য এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে (এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত)। প্রতিনিয়ত সদস্য বাড়ছে। এরই মধ্যে আমাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে। সামনে আরও অনেক চমক থাকছে।
সংগঠনের সভাপতি কানিজ আলমাস খান প্রসঙ্গে নীলোফার খন্দকার বলেন, আমরা কিছু উদ্যোক্তা ৯০ দশকে শুরুর দিকে দেশের রূপচর্চা শিল্পের প্রাথমিক বিকাশে কিছু কাজ করেছি। কিন্তু কানিজ আলমাস রূপচর্চার খাতকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। তাঁর সভাপতিত্বে আমাদের বিএসওএবি আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
স্বপ্ন দেখি বিশ্বমানের বিউটি ইন্সটিটিউটের
নীলোফার খন্দকার বলেন, শহরের আনাচে-কানাচে এত এত বিউটি পার্লার, স্যালন। দেখে মনে হয়- ঘরে ঘরে রূপচর্চা বিশেষজ্ঞের ছড়াছড়ি। সবাই বিউটিশিয়ান হতে চায়, কিন্তু কেউ শিখতে চায় না। আবার যারা ভাল কাজ করছেন, তাদের কোন রূপচর্চা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যাপারে কোন ভাবনা নেই। এ ব্যাপারটি আমাকে তাড়িত করে। তবে এই ইচ্ছাটি হয়তো আগামীতে পূরণ হতে পারে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন বিএসওএবি'র কল্যাণে।
| নীলো'স বিউটি স্যালনের ভেতরের চিত্র। ছবি: নতুন আলো
একটি ভাল মানের বিউটি স্যালনের মানদণ্ড কি হওয়া উচিত এমন প্রশ্নের উত্তরে নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নীলোফার খন্দকার বলেন, ভাল মানের বিউটি স্যালনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য পরিচ্ছন্নতা। তাছাড়া গ্রাহক সুপারিশও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। স্যালনের পরিবেশ, কর্মীদের দক্ষতা, গুণগত মানের রূপচর্চা সামগ্রীর ব্যবহার, সেবায় সন্তুষ্টি- এ বিষয়গুলোও একটি ভাল মানের বিউটি স্যালনের বৈশিষ্ট্য।
বিউটিশিয়ান হতে চাইনি
করাচির সেন্ট জোসেফ হাই স্কুলে নীলোফার খন্দকারের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। সেখানকার হোম ইকোনমিকস কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেন তিনি। একই কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়া শুরু করলেও তা সম্পন্ন করার আগেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। নীলোফার ১৯৬১ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে (পিআইএ) বিমানবালা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পিআইএ’র বৈমানিক সফদার ফিরোজ নানাকে বিয়ে করেন।
‘বিয়ের পরপরই আমি চাকরি ছেড়ে দিই। এর মধ্যে জাপানের একটি স্থানীয় এয়ারলাইন কোম্পানি সফদার ফিরোজকে হায়ার করে নিয়ে যায়। সেই সুবাদে আমারও জাপানে থাকার সুযোগ হয়। যদিও আমাদের দাম্পত্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।’
নীলোফার-সফদার দম্পতির বিয়ে ১৯৭১ সালে ভেঙ্গে যায়। সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার পর কঠিন মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় নীলোফারকে। এরপর তিনি বিদেশে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে সময় ভিসা পাওয়ার ব্যাপারটা মোটেও জটিল ছিলনা। বিদেশে কেন যাচ্ছি- ভিসায় তা উল্লেখও করতে হয়নি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় চলে গেলাম। বিদেশেই স্থায়ী হয়ে থেকে যাব বলে ভেবেছি।
| নিজ স্যালনে নীলোফার খন্দকার। ছবি: নতুন আলো
‘কেন বিদেশে এলাম, কি করবো এখানে- কিছুই ভাবিনি আগে থেকে।’
সুন্দরী, স্মার্ট, শিক্ষিতা, ইংরেজিতে ভালো দখল- এ সব গুণই ছিল নীলোফার খন্দকারের। ফলে কিছু একটা করতে পারবেন- এমন আত্মবিশ্বাস ছিল তার সহজাত।
'আমি এয়ার হোস্টেস কিংবা বিউটিশিয়ান হব- এমনটি আমার শৈশব স্বপ্ন ছিলনা। ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হয়ে গৃহিণী হব। সংসারী হব। সংসার নিয়েই থাকব।'
ইনিড বিউটি কলেজ আমার জীবন বদলে দেয়
যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় পৌঁছানোর মাস দুয়েকের মধ্যে নীলোফার খন্দকার রূপচর্চা সেবার প্রশিক্ষণ নেয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি সেখানকার ইনিড বিউটি কলেজে কসমেটোলজি কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলেন। এটি ছিল নয় মাস মেয়াদী একটি ডিপ্লোমা কোর্স।
‘কসমেটোলজি কোর্সটি দুটি স্তরে সম্পন্ন করতে হত। ৬ মাস মেয়াদী প্রাথমিক স্তরের (প্রাইমারি লেভেল) কোর্সটি সফলভাবে শেষ করতে পেরেছিলাম। কোর্স শুরু করার এক মাস পরেই বাকি পাঁচ মাসের জন্য আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। ফলাফলও বেশ ভাল করেছিলাম। পরবর্তী তিন মাস মেয়াদী উচ্চতর স্তরের (অ্যাডভান্সড লেভেল) কোর্সটিও বৃত্তি পেয়ে সম্পন্ন করি।’
নীলোফার বলেন, কসমেটোলজিতে পড়ার পর আমাকে বসে থাকতে হয়নি। আমার প্রথম কাজের কাজের সুযোগ হয় ওখানকার একটি স্থানীয় স্যালনে। নাম ছিল কনি’স বিউটি স্যালন। এখানে প্রায় তিন বছর চাকরি করেছি।
| যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার ইনিড বিউটি কলজে কসমেটোলজি বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছেন নীলোফার খন্দকার
‘ইনিড বিউটি কলেজ আমাকে রূপচর্চার মৌলিক বিষয়গুলো শিখিয়েছে। শিখিয়েছে রূপচর্চার নানাবিদ রূপান্তর (মডিফিকেশন)। আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, জীবন বদলে দিয়েছে ইনিড আর কসমেটলজি।’
এরপর নীলোফার খন্দকার ওকলাহোমা থেকে চলে গেলেন ভার্জিনিয়ায়।
‘১৯৭৫ সালের দিকে আমি ভার্জিনিয়ায় চলে যাই। সেখানে হেক্টস নামে জনপ্রিয় একটি সুপারশপ ছিল। এই সুপারশপের স্যালনে প্রায় দুই বছর কাজ করেছি।’ যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করেছি ভার্জিনিয়ায়, পারফেক্ট টেন স্যালনে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ওখানে কর্মরত ছিলাম।
বিদেশে অবস্থানকালে নীলোফার খন্দকার দেশে খুব বেশি আসেননি।
‘বিদেশে থাকাকালীন সময়ের মাঝে আমি দেশে দুবার এসেছি। শুধু মাকে দেখার জন্য। সবশেষে দেশে এলাম ১৯৯০ সালে। তাও মাকে দেখতে। এরপর আমার আর বিদেশে ফেরা হয়নি।’
| মা মরিয়ম বেগমের সঙ্গে নীলোফার খন্দকার
যেভাবে আজকের নীলো'স
৯০ দশকে ঢাকায় বিউটি পার্লার ছিল একেবারেই কম। এর মধ্যে লিলি’স, রোজ, লিসা’স, লিভিং ডল ছিল উল্লেখযোগ্য। কিংস নামে একটি চীনা রেস্তোরাঁর মালিকের স্ত্রীর ছিল একটি বিউটি পার্লার। শুরুতে এটির কোন নাম ছিলনা। পরে এটি মে ফেয়ার নামে চালু হয়। বেশিরভাগ বিউটি পার্লার চালাতেন বাংলাদেশে বসবাসকারী চীনারা। স্বাধীনতার পর চালু হওয়া লিভিং ডল ছিল একমাত্র দেশি বিউটি পার্লার। পুরানা পল্টনে এটি চালাতেন জেরিনা আজগর। ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকার গুলশানে এটি স্থানান্তর করেন।
নীলোফার খন্দকার বলেন, বনানীর ১৮ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাটে ইমা সালাহউদ্দিন (ফুটবল খেলোয়াড় কাজী সালাহউদ্দিনের স্ত্রী) চালাতেন নারীদের ব্যায়ামাগার। নাম ছিল জ্যাজারসাইজ। তার কাছ থেকে তার প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে আমি ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে শুরু করি নীলো’স বিউটি স্যালন। মাসে দুই হাজার টাকা ভাড়া দিতাম। তখন আমার কর্মী ছিল মাত্র একজন।
‘প্রথম মাসে আমার খরচ হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় মাসে আমার খরচ তো হয়নি বরং মুনাফা হয়েছিল। ধীরে ধীরে আমার নীলো’স-এ বিদেশীরা আসতে শুরু করে। আমেরিকান, জার্মান, ব্রিটিশ নারীরা এখানে আসা শুরু করে।’
কেমন খরচ পড়ত তখনকার রূপচর্চা সেবায়- জানতে চাইলে নীলোফার খন্দকার নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চুলকাটা ৭৫ টাকা, চুলে হাইলাইট করা ১২০০ টাকা, মেনিকিউর-পেডিকিউর ৫০ টাকা। তিন মাস আমি কোন ছুটির দিন রাখিনি। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকত নীলো’স।
এক বছর পর বনানীর ওই ১৮ নম্বর রোডেই একটি ফ্ল্যাটের দুটি কক্ষ ও তিনজন কর্মী নিয়ে কিছুটা পরিসর বৃদ্ধি করে তিনি শুরু করেন নীলো’স। তখন তার মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া গুণতে হত। এই ঠিকানায় ছিলেন প্রায় তিন বছর।
‘এরপর আমি চলে আসি গুলাশানে। এটি ছিল তৃতীয় ঠিকানা। তিনটি কক্ষ ও সাতজন কর্মী নিয়ে নীলো’স তৃতীয় ঠিকানায় যাত্রা শুরু করে গুলাশানে। এই ঠিকানায় ছিলাম ২০০০ সাল পর্যন্ত।’
বর্তমান ঠিকানায় (রোড ৫৫, বাড়ি ১২-বি, গুলশান ২) নীলো’স এর আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুট। কর্মরত আছে ৩২ জন কর্মী।
নীলোফার খন্দকার বলেন, বর্তমানে নীলো’স-এ রূপচর্চার যে কটি সেবা রয়েছে, সেসবের প্রায় সবগুলোই শুরু থেকে ছিল। পরে শুধু বডি মাসাজ যুক্ত করেছি।
‘তখনকার সময়ে চুলে রং করা (হেয়ার কালার) বলতে শুধু কালো রং বুঝাতো।’
চলতি বছরের এপ্রিলে নীলো'স বিউটি স্যালন ৩২ বছর পূর্ণ করেছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় কেমন ছিল নীলো'স এর পথচলা, জানতে চাইলে নীলোফার খন্দকার বলেন, আমি আমার স্যালন নিয়ে ভালো সময় পার করেছি। তবে করোনার দুই বছর ভীষণ চাপে পড়তে হয়েছিল। সঞ্চিত অর্থ খরচ করে স্যালন টিকিয়ে রেখেছি। এক কোটি টাকার বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছি। এখন আবার গুছিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
নীলো'স-এ রূপচর্চার প্রায় সব সেবা রয়েছে। তবে স্যালনটি হেয়ার কাট, হেয়ার কালারসহ চুলের নানা রকম সেবার জন্য অধিক সুপরিচিত।
এক প্রসঙ্গে নীলোফার খন্দকার বলেন, আমি এখনও দেশের বাইরে গেলে কোন না কোন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আপডেট থাকার চেষ্টা করি। রূপচর্চা খুব গতিশীল একটি সেবা। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সেবা, কলাকৌশল, কাঁচামাল যুক্ত হচ্ছে এই শিল্পে। আমি এসবের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত, হালনাগাদ রাখতে না পারলে আমার সেবার মান ধরে রাখতে পারব না। এখনকার মানুষজন খুব সচেতন। তারা নানা বিষয়ে অনেক খোঁজ খবর রাখতে সক্ষম। ফলে আমাকেও রূপচর্চার আধুনিক সব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়।
দেশে যারা রূপচর্চা নিয়ে ভালো কাজ করছেন, তাদের মধ্যে ফারজানা শাকিল, জাহিদ খান মেকওভার নিয়ে এবং হেয়ার কাট, হেয়ার কালার নিয়ে সৈয়দ কামরুল ইসলাম (বানথাই) ও সাবিকুন নাহার (হেয়ারবার) ভালো কাজ করছেন, জানান নীলোফার খন্দকার।
২০১২ সালে নীলোফার খন্দকার একটি রেস্তোরাঁ চালু করেছিলেন উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে। এর নাম ছিল পেটুক।
তিনি বলেন, আমাদের এখানকার আকনি পোলাও, কাচ্চি, মাছের কোপ্তা খুব পছন্দ করতো ক্রেতারা। এছাড়া আমাদের কুলফি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যদিও আমরা রেস্তোরাঁটি বেশি দিন চালাতে পারিনি। এক বছরের কিছু বেশি সময় এটি চালাতে পেরেছিলাম।
ব্যক্তি নীলোফার খন্দকার
কিংবদন্তি রূপ বিশেষজ্ঞ নীলোফার খন্দকারের জন্ম ১৯৪২ সালে ১০ অক্টোবর। ভারতের দিল্লীতে। নিজবাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার বানেশ্বরদী গ্রামে। বাবা এন এইচ খন্দকার। মা মরিয়ম বেগম। এন এইচ খন্দকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৯৫০’র দশকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারি প্রেসের (বর্তমান বিজি প্রেস) ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের মুদ্রণ ও মণিহারি বিভাগের নিয়ন্ত্রক (কন্ট্রোলার অব প্রিন্টিং অ্যান্ড স্টেশনারি) পদে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরি থেকে তিনি ১৯৭৪ সালে অবসর নেন।
নীলুফার খন্দকারের মা মরিয়ম বেগম ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। ব্যবসায়ি ও রাজনীতিক। ‘রূপায়ন’ নামে ব্লক ও স্ক্রিন প্রিন্টের ব্যবসা ছিল তার। সে সময়ে তুমুল জনপ্রিয় ওই ব্যবসার পরিসরও ছিল বেশ বড়। তিন দশকের (১৯৫২-১৯৮৬) সফল ব্যবসায়ি মরিয়ম বেগম পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ১৯৯৮ সালে বৃহত্তর ঢাকার ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন।
তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নীলোফার দ্বিতীয়। তার ভাই একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি। তার প্রয়াত বড় বোন রোজী লতিফ ছিলেন ইএমআই রেকর্ডিং কোম্পানির পরিচালক। ছোট বোন সুমনা হাসান বিউটি স্যালন স্টুডিও ২০০০ এর স্বত্বাধিকারী।
মাংস এড়িয়ে চলি, পছন্দ ছোট মাছ
নীলোফার খন্দকারের নিত্যদিনের জীবনযাপন প্রসঙ্গে জানা যায়, তিনি সাধারণত সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠেন। সাড়ে ৮টার মধ্যে নাশতা শেষ করেন। নাশতার পর এক কাপ কফি পান করেন। সোয়া ৯টার মধ্যে তিনি তার কর্মস্থল নীলো’স এর উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে কর্মস্থল থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পৌনে ৮টায় রাতের খাবার খান। এর বাইরে তিনি বলেন, 'টিভি দেখি, ইউটিউব দেখি। আর মায়ের সঙ্গে সময় কাটাই।'
‘খাবারে সাধারণত ছোট মাছ আর ফল সবসময়ই থাকে। মাংস সাধারণত এড়িয়ে চলি, সপ্তাহে একদিনের বেশি না খাইনা।’
বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করেন নীলোফার খন্দকার। ‘কিন্তু এখন আর একা একা বেড়াতে যেতে ভাল লাগে না।’ মাকে নিয়ে নীলোফার খন্দকার উত্তরায় বসবাস করেন।
এক নজরে নীলোফার খন্দকার
১৯৪২: নীলোফার খন্দকারের জন্ম (১০ অক্টোবর)
১৯৫৯: ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। সেন্ট জোসেফ হাই স্কুল, করাচি থেকে।
১৯৬১: ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। হোম ইকোনমিকস কলেজ, করাচি থেকে।
১৯৬১: পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে বিমানবালা হিসেবে কর্মজীবন শুরু
১৯৬৫: বিয়ে করেন, স্বামী বৈমানিক ছিলেন। কর্মজীবন ছেড়ে সংসারে মনযোগী হন
১৯৭১: বিবাহ বিচ্ছেদ। এরপর আর বিয়ে করেননি তিনি।
১৯৭২: যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান
১৯৭২: ওকলাহোমার ইনিড বিউটি কলেজ থেকে বৃত্তি পেয়ে কসমেটোলজি বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন
১৯৭৩: রূপচর্চা খাতে প্রথম কর্মজীবন শুরু।
ওকলাহোমার কনি'স বিউটি স্যালনে কর্মরত ছিলেন ৩ বছর।
১৯৭৫: ভার্জিনিয়া যান।
সেখানকার 'হেক্টস' নামে একটি সুপারশপের স্যালনে দুই বছর কর্মরত ছিলেন।
১৯৭৭: ভার্জিনিয়ার পারফেক্ট টেন স্যালনে বিউটিশিয়ান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
ক্যারিয়ারের দীর্ঘতম সময় তিনি এখানে অতিবাহিত করেন, প্রায় ১৩ বছর।
১৯৯০: বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
১৯৯০: এপ্রিল মাসে বনানীতে নীলো'স বিউটি স্যালন চালু করেন। স্যালনের আয়তন ছিল ১টি কক্ষ। কর্মী ১ জন।
১৯৯১: নীলো'স বিউটি স্যালনের আয়তন দাঁড়ায় ২টি কক্ষ। কর্মী ৩ জন।
১৯৯৪: গুলশানে স্থানান্তরিত হয় নীলো'স, আয়তন দাঁড়ায় ৩টি কক্ষ সঙ্গে ৭ জন কর্মী।
২০০০: গুলশানের বর্তমান ঠিকানায় আসে নীলো'স।
আয়তন দাঁড়ায় ৪ হাজার বর্গফুট, কর্মরত আছেন ৩২ জন কর্মী।
২০২০: এবং ২০২১ সালে করোনাভাইরাস মহামারিতে ব্যবসায় এক কোটি টাকার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন
২০২২: বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএসওএবি) এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি (২০২১-২০১৩)