শুক্রবার । মার্চ ২৯, ২০২৪ । । ১২:৫২ পিএম

ঐতিহ্যবাহী বিকল্প ধরে রেখেছি ৩৪ বছর: মাহবুবুর রহমান

সৈনূই জুয়েল | নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকম
প্রকাশিত: 2018-04-16 00:13:34 BdST হালনাগাদ: 2018-04-30 15:18:38 BdST

‘বাসে যাত্রী নিয়ে ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে ময়মনসিংহের তৎকালীন পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ, পরিচয় হয়। তিনি জানলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঋণ নিয়ে মিনিবাস চালাচ্ছি। সব শুনে তিনি আমাকে খুব মূল্যায়ন করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমাকে ওই অনুষ্ঠানে ম্যান অব দ্য প্রোগ্রাম ঘোষণা করলেন। বিষয়টি আমাকে খুব আনন্দিত করেছিল। এ ঘটনাটি আমাকে এখনও খুব আপ্লুত করে।’



পরিবহন ব্যবসায় সাফল্য পাওয়া অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এভাবেই তার কর্মজীবনের এক আলোকিত ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন।


 


সোনালী ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্পের (বিকল্প) আওতায় ১৯৮৪ সালে ঋণ নিয়ে পরিবহন ব্যবসায় তার অভিষেক।



নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে বিকল্প পরিবহন সমিতির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের ব্যক্তি ও কর্মজীবনের নানা অনুষঙ্গ।


মিরপুর ১২ নম্বরে অবস্থিত বিকল্প পরিবহন সমিতির কার্যালয়ে অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান
সফল পরিবহন ব্যবসায়ি মাহবুবুর রহমানের জন্ম লক্ষ্মীপুরের রামগতি থানার বালুরচর গ্রামে। বাবা মতিউর রহমান। মা লুৎফন্নেসা। দুজনেই প্রয়াত। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে মাহবুবুর পঞ্চম।



মাহবুবুর রহমানের শৈশব ও বেড়ে ওঠা ভোলা সদরের চর ভেদুরিয়া গ্রামে। মেঘনার ভাঙ্গনে বসতবাড়ি, জমি বিলীন হয়ে গেলে তার পরিবার রামগতি থেকে ভোলায় চলে আসেন।



স্থানীয় ব্যাংকের হাট কোঅপারেটিভ ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়।



‘মূলত আমার বড় ভাই খোরশেদ আলম আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। আমার শিক্ষাজীবন সার্থক হবার পেছনে বড় ভাই, মা আর ভাবীর অবদান অনেক বেশি।’



রাত জেগে পড়ার অভ্যাস ছিল মাহবুবুর রহমানের। মা লুৎফন্নেসা রাত জেগে ছেলেকে বাতাস করতেন।



"আমি রাত জেগে পড়ছি। মা হাতপাখায় আমাকে বাতাস করছেন। আমার টেবিলে মোটা ডিকশনারি দেখে বলছেন, এত মোটা বইটা তুমি ক্যামনে মুখস্ত কর, বাবা? বললাম- মা, এইটা তো মুখস্ত করতে হয়না। এইটার নাম ডিকশনারি। কোন ইংরেজি শব্দের অর্থ না বুঝলে, এইটা দেখে অর্থ জেনে নেয়া যায়। এরপর একদিন কোন এক প্রেক্ষিতে মা বলছিলেন- বাবা তোমার ‘ডিশম্বর’ বইটা খোল তো...। ডিকশনারিকে ‘ডিশম্বর’ বলেছিলেন মা। মায়ের এই কথা শুনে হেসেছিলাম খুব। এমন অনেক মজার স্মৃতি আছে মাকে নিয়ে। এখন মা নেই। ভীষণ মনে পরে মাকে।"


 


মাহবুবুর রহমান বলেন, মা পড়াশোনা জানতেন না। বাবা কৃষক ছিলেন। নদীভাঙ্গনে বাড়ি, জমিসহ সর্বস্ব হারানো একটি পরিবারের সন্তানের পড়াশোনা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল তখনকার সময়ে। আমারও পড়াশোনা করার তেমন কোন সম্ভাবনা ছিলনা। আমার পড়াশোনায় মায়ের সহযোগিতা, যত্ন- অনেক বড় পাথেয় ছিল।


ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর সঙ্গে সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান
ভাবী মোরশেদা খাতুনও ছিলেন মাহবুবুর রহমানের পড়াশোনায় যত্নশীল। হাতখরচের টাকা-পয়সার তেমন রীতি ছিলনা সে সময়। তার মধ্যে অভাবী সংসার। তবে বাদাম খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন মাহবুবুর। কিন্তু পয়সাকড়ি কোথায় পাবেন বাদাম কিনতে।



তাই ‘ভাবী স্কুলে যাওয়ার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে চাল দিয়ে দিতেন বাদাম কিনে খেতে।’



বড় ভাইয়ের উৎসাহে ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন মাহবুবুর। কিন্তু নিজ বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেশি হওয়ায় তার ফুপুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনার সুযোগ মেলে তার।



ভোলা সদরের উকিলপাড়ায় থাকতেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী ঠিকাদার মাহে আলম। তার বাড়িতে থেকে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করার সুযোগ হয় মাহবুবুরের। মাহে আলমকে দেখে ভেবেছিলেন বড় হয়ে প্রকৌশলী হবেন তিনি।


পরিবহন ব্যবসায়ি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য
‘উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ভাল হয়নি। তাই প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন পূরণ হলোনা।’



তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে আমি ছাত্রলীগে যোগ দেই। তখন বিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ ছিল। আমাদের নেতা ছিলেন তোফায়েল আহমেদ (বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী)।



মাহবুবুর বলেন, ১৯৭০ সালে ভোলায় প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় হয়। বাড়ির উঠানে কোমর পর্যন্ত পানি জমেছিল। জানা ছিল, আজান দিলে নাকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তাই আজান দিয়েছিলাম সেদিন।



‘দৌলতখান উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়কবলিত মানুষকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের আয়োজন করেছিল ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন। তাদের সঙ্গে ত্রাণসামগ্রী দিতে পানিতে নেমে বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি। দেখেছি- পানিতে ভাসছে মানুষের লাশ। মৃত গরু-ছাগল ভাসছে। বড় বড় গাছ শিকড়সহ উপড়ে পড়ে আছে। আবার গাছের উপরেও মানুষের লাশ ঝুলছে। ঘূর্ণিঝড়ের এমন তাণ্ডব দেখে আমি সেদিন রাত ঘুমাতে পারিনি।’


বিকল্প পরিবহনের বাস- বিকল্প অটো সার্ভিস ও বিকল্প সিটি সুপার সার্ভিস। দুটি রুটে বিকল্প পরিবহনের বর্তমানে ৯০টি বাস চলছে।
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বরে ভোলা ঘূর্ণিঝড় (ঘূর্ণিঝড় গোর্কি) নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন মাহবুবুর রহমান।



ওই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ফসলহানীসহ ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। সিম্পসন স্কেলে 'ক্যাটাগরি ৩' মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি।



মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করতে না পারলেও, খাবার, থাকার জায়গা, রাজাকারদের ব্যাপারে তথ্য প্রদানসহ নানা বিষয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছি। এমন অনেক দিন গেছে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বাঁশঝারের আড়ালে রাত্রিযাপন করেছি।



১৯৭২ সালে মাহবুবুর রহমান ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেনিতে মাধ্যমিক পাশ করেন।



‘ওই বছর দুটি মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়েছিল। আমি দ্বিতীয় পরীক্ষায় পাশ করি। ৬টি বিষয়ে ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়েছিল সেটি।’


ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান
১৯৭৫ সালে তিনি ভোলা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৮ সালে স্নাতক ও ১৯৭৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।



বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে থাকতেন মাহবুবুর রহমান। জহুরুল হক হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি সে সময় সহ-ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন।



‘আমাদের ভিপি ছিলেন খলিলুর রহমান মোহন। তিনি বর্তমানে পটুয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মনিরুজ্জামান মনির। তিনি এখন ঢাকা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর’



মাহবুবুর রহমান বলেন, বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের তীব্র ক্ষোভ ছিল, ফলে অনেক ছাত্র গ্রেপ্তার হতে শুরু করে। গ্রেপ্তার এড়াতে আমি ঢাকা থেকে পাবনা চলে গেলাম আমার এক বন্ধু শাহজাহানের কাছে। সে তখন কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে (কেডিসি) চাকরি করত।


সফল পরিবহন ব্যবসায়ি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য
‘বন্ধু আমাকে একদিন কেডিসি অফিসে তার বসের কাছে নিয়ে গেল। তিনি ছিলেন কোরিয়ান। নাম আইএস পার্ক। নানা কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি আমাকে কেডিসিতে যোগ দিতে বললেন।’



১৯৮২ সালের মার্চে মাহবুবুর রহমান কেডিসিতে লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার পদে যোগ দেন। শুরু হয় তার কর্মজীবন। বাংলাদেশে কেডিসির প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে ১৯৮৪ সালে তিনি আবার বেকার হয়ে পড়েন।



মাহবুবুর আবারো ঢাকায় ফিরে আসেন। উঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের সেই কক্ষে, ছাত্রজীবনে যেখানে থাকতেন।



“১৯৮৪ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। ফুলার রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দেখা হয়ে গেল ফিন্যান্স বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক মুহম্মদ নাসিরউদ্দিন স্যারের সঙ্গে। কি করছি- স্যার জানতে চাইলেন। বেকার অবস্থার কথা স্যারকে জানালাম। স্যার জানালেন সোনালী ব্যাংকের ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প (বিকল্প)’ সম্পর্কে।”



১৯৮৪ সালে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফর রহমান সরকার ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প (বিকল্প)’ নামে একটি ঋণ প্রকল্প চালু করেন। প্রকল্পটির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা তরুণদের একাডেমিক সার্টিফিকেট জমা রেখে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিত ব্যাংকটি।


কিংবদন্তি ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার, যিনি ১৯৮৪ সালে সোনালী ব্যাংকে চালু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প (বিকল্প)
‘বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা আমাদের ৪০ জনকে পাঠানো হল জয়দেবপুরে বিআরটিসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ড্রাইভিং শিখতে। আমি জানতে চাইলাম, এত কিছু থাকতে আমাদের ড্রাইভিং কেন শিখতে হবে। স্যার বলেছিলেন, শিক্ষিত ছেলেরা যদি ড্রাইভিং পেশায় আসে, তাহলে এই পেশার কদর বাড়বে। গণপরিবহন সেবার মান বাড়বে। বিকল্পের প্রধান লক্ষ্য ছিল- শ্রমের মর্যাদা বা ডিগনিটি অব লেবার প্রতিষ্ঠা ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা । আমরা তিন মাসের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ শেষ করলাম’



বিকল্প’র আওতায় ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে 'বিকল্প পরিবহন স্কিম' নামে প্রথম প্রকল্প উদ্বোধন করেন লুৎফর রহমান সরকার। শনিবার (১৪ এপ্রিল) ছিল বিকল্প পরিবহনের ৩৪ বছর পূর্তি।



‘আমরা যারা ড্রাইভিং শিখেছিলাম তাদের মধ্যে ১৬ জনকে ৪টি বাস দেয়া হল। তিন বছরে ৩৬টি মাসিক কিস্তিতে বাসের মূল্য পরিশোধ করার শর্তে। প্রতি চারজনের একটি গ্রুপ হিসেবে চারটি গ্রুপকে চারটি বাস দেয়া হল। গাড়ি চালানো, ভাড়া তোলাসহ সব কাজ আমরা নিজেরাই করতাম। পরবর্তীতে প্রতি গ্রুপে আরও একটি করে বাস দেয়া হয়। সব মিলিয়ে সে সময় সোনালী ব্যাংকের অর্থায়নে ৫৬ জনকে ২৪টি বাস দেয়া হয়েছিল।’



ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে চালু হয়েছিল বিকল্প পরিবহন। ঢাকায় ১৫টি, চট্টগ্রামে ৪টি ও রাজশাহীতে ২টি গ্রুপ নিয়ে বিকল্প পরিবহন চালু হয়।
কিছুদিনের মধ্যে মিনিবাস প্রকল্পের সম্প্রসারণ হিসেবে ট্যাক্সি প্রকল্প চালু হয়। দেয়া হয় ১০০টি কালো ট্যাক্সি।


 


'চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বিকল্প পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে বেশ আগেই। শুধু ঢাকায় আমরা বিকল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছি ৩৪ বছর।'



বিকল্পের আওতায় বিকল্প ডেন্টাল ক্লিনিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, পিপিক্যাপ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ফটোস্ট্যাটসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু হয়। সে সময় ৩৮টি খাতে ‘বিকল্প’ ঋণ দেওয়া হতো।



মাহবুবুর রহমান বলেন, ঢাকায় বিকল্প পরিবহনের প্রথম রুট ছিল মিরপুর থেকে ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান)। এরপর বিকল্প পরিবহনে পর্যায়ক্রমে মিরপুর-সায়েদাবাদ, মিরপুর-যাত্রাবাড়ি রুট যুক্ত হয়। তখন বিকল্প পরিবহনের বাসের গায়ে লেখা থাকত বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প। সামনের গ্লাসে লেখা থাকত বিকল্প। পিছনে লেখা থাকত সোনালী ব্যাংকের নাম।


অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য
‘বিকল্প পরিবহনের সোনালী সময় ছিল ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। বিকল্প পরিবহনে অল্প কিছু বাস ছিল। কিন্তু অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে আমাদের সম্মান, সুযোগ-সুবিধা বেশি ছিল। রাস্তাঘাটে ট্রাফিক পুলিশ কখনো হয়রানি করত না। পুলিশকে ঘুষও দিতে হতনা। যাত্রীরাও ভাল ব্যবহার করত।’



বিকল্পের জন্য দুঃসময় ছিল ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল। লুৎফর রহমান সরকারের বিকল্প নানা কারণেই ছিল আলোচিত, প্রশংসিত ও তুমুল জনপ্রিয়। এই প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের সবাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী।



মাহবুবুর রহমান বলেন, বিকল্পকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা করেন স্বৈরশাসক এরশাদ। তিনি তার ছাত্রনেতাদের বিকল্পের ঋণ দেয়ার ও তার অনুগত জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে (জাতীয় পার্টি নেতা ও বর্তমানে এরশাদের ভাগনি জামাই) প্রকল্পের উপদেষ্টা করার প্রস্তাব দেন লুৎফর রহমানকে। এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে লুৎফর রহমানকে সোনালী ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এমনকি তাকে সামরিক আইনে বিচার করে জেলে পাঠানো হয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপর থেকেই বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্পের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম। এর প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন শুরু করি। সোনালী ব্যাংকের ঋণের কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দেই। বিষয়টি নিয়ে স্যার আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হন। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ বন্ধ না করার পরামর্শ দিলেন তিনি। এরপর আমরা আবার কিস্তি দেয়া শুরু করি। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ২৪টি বাসের ঋণ পরিশোধের ঝামেলা শেষ হয় ২০০০ সালে।



মাহবুবুর রহমান ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ল’ কলেজে ভর্তি হন। ওই বছর তিনি নিজ গ্রামের মেয়ে ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি এলএলবি সম্পন্ন করেন। ২০০২ সাল থেকে তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য। পরিবহন খাত নিয়ে ব্যস্ততার কারণে তিনি আইনচর্চায় নিয়মিত নন।



আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী মাহবুবুর রহমান যুক্ত আছেন পরিবহন রাজনীতির সঙ্গে। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।



‘ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর নেতৃত্বে আমরা গণপরিবহন খাতে উন্নত যাত্রীসেবা দিতে কাজ করছি।’


অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের বক্তব্য
মাহবুবুর রহমানের দুই ছেলেমেয়ে। বড় সন্তান মুশফিকুর রহমান অমি। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। হোটেল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়া পড়াশোনা করছেন। মেয়ে ফারজানা রহমান নিশিতা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী।



২০০০ সালে ব্যাংকঋণ পরিশোধের পর বিকল্প পরিবহন নিজেদের অর্থায়নে ঘুরে দাঁড়ায়, বৃদ্ধি পায় ব্যবসার পরিসর।



মাহবুবুর রহমান নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকঋণ পরিশোধ করার পর ২০০১ সালে বিকল্প পরিবহনে আমরা নিজেদের অর্থায়নে ৫০টি বাস যুক্ত করি। ২০০২ সালে ৩৬টি বাস নিয়ে বিকল্প অটো সার্ভিস নামে নতুন ব্যানারে আমরা আমাদের গণপরিবহন কার্যক্রম চালু করি। ২০০৪ সালে ৪০টি বাস নিয়ে মিরপুর-ঢাকেশ্বরী (৩৬ নম্বর বাস নামে অধিক পরিচিত) রুটে বিকল্প সিটি সুপার সার্ভিস চালু করি। মিরপুর ১২ থেকে মিরপুর ১ হয়ে যাত্রাবাড়িগামী ১৪-বি রুটে বাস চালু করি ২০০৫ সালে। সব মিলিয়ে ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমাদের নিজেদের বিকল্প পরিবহনে বাস ছিল ১৫০টি। বর্তমানে বিকল্প পরিবহনে দুটি রুটে ৯০টি বাস চলছে।



মিরপুরে এখনও বিকল্প পরিবহন যথেষ্ট জনপ্রিয়। কিংবদন্তি ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকারের উদ্ভাবিত সোনালী ব্যাংকের বিকল্প পরিবহন স্কীম এখন শুধু মিরপুরেই সেই ঐতিহ্যের ধারা বহন করছে, শুরু থেকেই যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান।



বিকল্প পরিবহন সমিতির সদস্য বর্তমানে ২০ জন, যারা সেই ১৯৮৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর গণপরিবহন খাতে যুক্ত হন। আজকের তারা সফল ও গর্বিত পরিবহন মালিক।



মিরপুরে ইস্টার্ন হাউজিংয়ে ২০ কাঠা জমিতে নির্মিত হচ্ছে বিকল্প টাওয়ার। বিকল্প পরিবহন সমিতির ২০ জনসহ মোট ২৮ জনের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে এই আটতলা আবাসিক ভবন। বিকল্পের ঐতিহ্য ও স্মৃতি ধরে রাখতে ভবনের নাম রাখা হয়েছে বিকল্প টাওয়ার।


মিরপুরে বিকল্প সমিতি কার্যালয়ে অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের
যারা বিকল্পের ঋণ নিয়েছিলেন তাদের সবাই আজ মূল প্রকল্প সম্প্রসারণের পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পেয়েছেন সাফল্য। অথচ বিকল্পের সব প্রকল্পে সোনালী ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ কোটি টাকা।



আগামিতে বিকল্প পরিবহনে নতুন বাস, নতুন রুট যুক্ত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আপাতত আমরা নতুন কোন রুট বা নতুন বাস যুক্ত করছিনা। তবে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের একটি চমৎকার পরিকল্পনা ছিল। ঢাকায় গণপরিবহনের সব বাস একটি প্ল্যাটফর্মে থেকে যাতায়াত করবে। সব বাস একই রঙের, নকশার হবে। সব বাসে উন্নত যাত্রীসেবা থাকবে। এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকার গণপরিবহন বদলে যেত। আমাদের প্রত্যাশা- এটি বাস্তবায়ন হোক।



মেয়র যেহেতু এখন নেই- সেক্ষেত্রে এটি আদৌ বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করেন কি- এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুর রহমান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অনেক বিষয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে তিনি হয়ত এসব বিষয় আমলে নিবেন।