বৃহস্পতিবার । ডিসেম্বর ৫, ২০২৪ । । ০৯:৪৭ এএম

নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন

ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে অনন্য ভূমিকা রাখবে এলআইসিএইচএসপি

এসএএম ফজলুল কবির, প্রকল্প পরিচালক, এলআইসিএইচএসপি
প্রকাশিত: 2018-04-26 14:15:08 BdST হালনাগাদ: 2018-07-09 10:16:58 BdST

Share on

এসএএম ফজলুল কবির, সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়), জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। একইসঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যেও একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এক লাখ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই ভূখণ্ডে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বসবাসের মধ্য দিয়ে দ্রুত নগরায়ন ঘটছে বাংলাদেশে। বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান নগরায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।


বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ শতাংশ ছিল। ২০১০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি মানুষের বসবাস শহরে, যার প্রায় ২১ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। সঙ্গত কারণেই শহরে ও নগরে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের জনবসতি বেড়েছে।


নির্বাচিত নিম্ন আয়ের জনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করতে "স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থা প্রকল্প (এলআইসিএইচএসপি)" বা “Low Income Community Housing Support Project (LICHSP)” নামে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

সিরাজগঞ্জের রাণীগ্রামের (প্রকল্প এলাকা) বর্তমান চিত্র
কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ১৯টি কমিউনিটির ৫ হাজার ৭০০ পরিবার সরাসরি এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হবে। এই প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক।


এলআইসিএইচএসপি নির্বাচিত এলাকাগুলোর ১৯টি কমিউনিটির বসতি উন্নতি করবে এবং তাদেরকে বাড়ি তৈরির জন্য আবাসন ঋণ পেতে সহায়তা করবে। প্রত্যেক পরিবার তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঋণ পাবে। ঋণ পরিশোধ সাপেক্ষে পরিবারগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী পুনরায় ঋণ নিতে পারবে।


ওই তিন শহরে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের জন্য জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করবে। মোট প্রকল্প খরচ ৩০৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ২৪৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৫৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। গত বছরের এপ্রিলে প্রকল্পটি শুরু হয়, যা চলবে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত।

নির্বাচিত কমিউনিটির পরিবারগুলোর সঙ্গে প্রকল্পের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে
আমাদের পর্যবেক্ষণ, একটি পরামর্শক দল কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জ শহরে ৩০টি কমিউনিটির মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে। প্রাথমিকভাবে কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জের জন্য প্রতি শহরে ৭টি করে মোট ১৪টি কমিউনিটি নির্বাচিত করা হয়েছে এবং বাকি কমিউনিটিগুলো নারায়ণগঞ্জ থেকে নির্বাচিত করা হবে।


প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য- নির্ধারিত এলাকাগুলোতে নিয়মবহির্ভূতভাবে বসবাসরত কম আয়ের বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়ন করা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়- (১) কমিউনিটি নির্বাচন, তাদের সংগঠিতকরণ এবং লেআউট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কমিউনিটিগুলোর সময়সীমার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; (২) উন্নত শহর পর্যায়ে পরিকল্পনার জন্য জিআইএস মানচিত্রের উন্নয়ন করা; (৩) পৌর স্তরে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নির্ধারিত এলাকাগুলোর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অবকাঠামো প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ; (৪) পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত অবকাঠামো এবং পরিষেবা প্রদানে সহায়তাকরণ; এবং (৫) কমিউনিটি গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শিখন কর্মসূচি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিউনিটি নেটওয়ার্ককে শহরে পর্যায়ে শক্তিশালীকরণ।


ঘরবাড়ির নিশ্চয়তা দেয়া, বস্তি এলাকায় ভুমি উন্নয়ন করা, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় স্তরের অবকাঠামো নির্মাণ করার (প্রত্যেক কমিউনিটিতে অভ্যন্তরীণ সড়ক, পয়োনালা, পানির সরবরাহ ইত্যাদি ব্যবস্থাসহ) নিশ্চয়তা দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আগ্রহী করে তোলার মাধ্যমে কমিউনিটি নির্বাচন করবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। আর নির্বাচিত কমিউনিটির পরিবারগুলোকে বাড়ি তৈরির জন্য ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে পিকেএসএফ।
বাড়ি তৈরির জন্য ঋণ পাবে সেসব পরিবার যাদের নিজস্ব ভূমি, ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা এবং সঞ্চয় রয়েছে। তাছাড়া আমরা ঋণের মেয়াদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণেও কাজ করবো।

প্রকল্পের সুবিধা পাবে যেসব পরিবার তাদের বর্তমান অবস্থার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন প্রকল্প পরিচালক ফজলুল কবির
এলআইসিএইচএসপি একটি বিশেষায়িত পাইলট প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এবং আমরা এ লক্ষ্যে কাজ করছি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এর অধীনে এমন প্রকল্প বাংলাদেশে এটিই প্রথম।


এটি অত্যন্ত চমৎকার ব্যাপার যে, বিশ্বব্যাংক যে পরিমাণ অর্থ গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে প্রকল্পের জন্য দিচ্ছে, তার পুরোটাই দিচ্ছে অনুদান হিসেবে। প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পটি তিনটি শহরে চলবে। তবে ভবিষ্যতে এ প্রকল্পটি দেশের বিভিন্ন শহরে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ব্যাপারেও প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংকের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে।


এরই মধ্যে প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আইএমসি ওয়ার্ল্ডওয়াইড এ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। পরামর্শক দলে আছেন ১১ জন বিশেষজ্ঞ, যাদের মধ্যে দুইজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞও। এই পরামর্শক দলটি কমিউনিটি নির্বাচন, মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুত করা, অবকাঠামোর নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধান করবে।


বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে এই প্রথম অনুদান-সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৬ সালের ১০ মে "স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থা প্রকল্প (এলআইসিএইচএসপি)" অনুমোদন করে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছে।

২ ও ৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের একটি দল পরিদর্শন করে এসেছেন প্রকল্প এলাকা
প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এবং অবশ্যই এটি উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে উন্নত বাংলাদেশে রূপান্তরে অনন্য ভূমিকা রাখবে।


২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তিকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিশন-২০২১ শিরোনামে ২৩ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।


এর মধ্যে পাঁচটি বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয় ওই রূপকল্পে। সেগুলো হলো- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ, বৈষম্য রুখে দারিদ্র বিমোচন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা।


বৈষম্য রুখে দারিদ্র বিমোচনের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী জোর দেন। ফলে নানা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কার্যকরী পদক্ষেপ এলআইসিএইচএসপি।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে এলআইসিএইচএসপি প্রকল্পটি অনন্য ভূমিকা রাখবে।

 

লেখক: এসএএম ফজলুল কবির, সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়), জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ও প্রকল্প পরিচালক, এলআইসিএইচএসপি



  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত