তিনি একজন ডাক্তার। একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তার। রয়েছে মেধাবী শিক্ষাজীবন। এর বাইরে তিনি একজন সঙ্গীত অনুরাগী, শৌখিন শিল্পী। ভালবাসেন লেখালেখি। আপ্লুত হন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। যার কথা বলছিলাম তিনি ড. এ এম এম আনিসুল আউয়াল।
সম্প্রতি নতুন আলো টোয়েন্টিফোর ডটকমের একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসছে আনিসুল আউয়ালের ব্যক্তি ও কর্ম জীবনের নানা অনুষঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈনূই জুয়েল।
ড. এএমএম আনিসুল আউয়ালের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার সিদ্দিকবাজার এলাকায়। বাবা একেএম আব্দুল আউয়াল ছিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে অবসরে যান। মা ইফফাত আরা আউয়াল। পরিবারে পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে আনিসুল আউয়াল সপ্তম।
বাবার কর্মজীবনের সুবাদে আনিসুল আউয়ালের শৈশব কেটেছে জামালপুরে। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি চট্টগ্রামে। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৭৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ছাত্রজীবনের প্রতিটি স্তরে মেধার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে একই বছর তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল সেন্ট মার্টিন।

আনিসুল আউয়াল বলেন, সে সময় সেন্ট মার্টিনের জনসংখ্যা ছিল ১৭২২ জন। বছর দশেক আগে শেষবার সেন্ট মার্টিনে গিয়েছিলাম। খুবই হতাশাজনক অবস্থা। জিনিসপত্রের অতি উচ্চমূল্য। পরিবেশের অবস্থা নাজুক। মানুষের ভিড় বেড়েছে।
সে সময় তিনি পার্বত্য অঞ্চলের মহালছড়িসহ বিভিন্ন দুর্গম উপজেলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে এক বছরের একটি কোর্স করার সুবাদে তিনি জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে (নিপসম) পদায়ন পান।
পুষ্টি কার্যক্রমকে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে গেছি
আনিসুল আউয়াল ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে পিজি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৃত্তি (স্কলারশিপ) নিয়ে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। অবস্থান করেন ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। সেখানকার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমিউনিটি নিউট্রিশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। তিনি ১৯৯৪ সালে ‘আয়োডিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সঙ্গে থাইরয়েড গ্রন্থির সম্পর্ক’ বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
দেশে ফিরে তিনি ১৯৯৫ সালে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন) পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প’এ বদলি হয়ে আসেন।

আনিসুল আউয়াল বলেন, আমি যখন এই প্রকল্পে দায়িত্বরত ছিলাম, তখন প্রান্তিক পর্যায়ে এবং জনসাধারণের জন্য বৃহৎ আকারে পুষ্টি নিয়ে কাজের অবকাঠামো ছিল না। তখন প্রকল্পের আর্থিক আকার ছিল এক কোটি টাকার। আমি যখন ওখান থেকে বদলি হয়ে যাই, তখন আমি শত কোটি টাকার বরাদ্দের ব্যবস্থা করে গিয়েছি। প্রকল্পের আকার অবকাঠামো বৃদ্ধি করেছি। পুষ্টি কার্যক্রমকে জনসাধারণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। প্রান্তিক মানুষজনকে পুষ্টির আওতায় আনার চেষ্টা করেছি।
২০০১ সালে তিনি জাতীয় পুষ্টি প্রকল্পে (এনএনপি) যোগদান করেন।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমি- এই তিনজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প নকশা তৈরি করা হয়। দুই বছর ধরে এ কার্যক্রমের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। অবশেষে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ৯শ কোটি টাকার (১.১৭ বিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ নিতে সক্ষম হয়েছিলাম। ২০০৬ সালে জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচীতে রুপান্তরিত হয়।

২০০৯ সালে আনিসুল আউয়াল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১০ সালে তিনি জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) পরিচালক পদে যোগ দেন। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও প্রশাসন- তিনটি উইংয়ে তিনি বিভিন্ন মেয়াদে পরিচালক পদে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এসব দায়িত্বে থাকাকালে তিনি ১৪টি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল লিখেন।
তিনি বলেন, ২০১২ সালে নিপোর্টে ১৮ মাস মেয়াদী একটি কোর্স চালু করি। প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি ডাক্তাররা থাকতে চান না। কিন্তু সেখানকার মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানো জরুরি। বিভিন্ন এনজিও ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষিত মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা বাড়াতে আমি এ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এখন নিপোর্টে এই কোর্সটি না থাকলেও, ২১টি এনজিওতে আমার ওই কোর্স চালু আছে।
২০১৪ সালে আনিসুল আউয়াল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি যোগ দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। সেফটি ও সিকিউরিটি নিয়ে তিনি নানা উদ্যোগে সম্পৃক্ত হন। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ, ট্রেড সংস্থার প্রতিনিধিসহ ১৬৪ জনকে তিনি জার্মানি থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে তিনি অবসরে যান।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে তিনি বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন এবং কেন্দ্রীয় তহবিল- এ দুই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে তিনি অবসরে যান।
এখন যা নিয়ে ব্যস্ত
ড. এএমএম আনিসুল আউয়াল ২০০১ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি কেনেন। এখন এ জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১০ বিঘা। ২০১৪ সালে তিনি সে জমিতে গড়ে তোলেন আউয়াল’স ড্রিম অ্যান্ড শাহিনবাগ রিসোর্ট। এ রিসোর্ট নিয়ে আগামিতে আরও আধুনিক সেবা-সুবিধা যুক্ত করবেন তিনি।
তিনি বলেন, এ রিসোর্ট নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। একটু নিরিবিলি পরিবেশ, গাছ-পালা, প্রকৃতি আমাকে ভীষণ টানে। অল্পবিস্তর লেখালেখি করি, সঙ্গীত চর্চা করি। আমি শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী। প্রায়ই রিসোর্টে আসি, থাকি। সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি থাকা হবে। মহামারি করোনা, লকডাউন- ইত্যাদি কারণে রিসোর্ট এখন বন্ধ রয়েছে।
২০০ গানের কভার করবো
আনিসুল আউয়াল একজন সঙ্গীত অনুরাগী। শুধু তাই নন তিনি গানের চর্চা করেন। গান নিয়ে তার সামনে বড় পরিকল্পনা আছে। এরই মধ্যে তিনি এএ টিভি নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল করেছেন। সেখানে বেশ আয়োজন করে জনপ্রিয় গানের কভার করছেন। প্রাণের গান শিরোনামে ওয়েব অনুষ্ঠানে এরই মধ্যে তার দুটি গান প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি বলেন, গান নিয়ে আমার বড় পরিকল্পনা আছে। ২০০ গানের কভার করতে চাই। সেভাবেই এগুচ্ছি। মৌলিক গান করার পরিকল্পনা আছে। নিজেও গান লেখার চেষ্টা করছি। আমি জনমত, অভিমত, পুষ্টিকথাসহ বিটিভির বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময় উপস্থাপনা করেছি।
আনিসুল আউয়াল ১৯৮৬ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী মাইক্রোবায়োলজির বিশিষ্ট অধ্যাপক ডা. শাহিন আরা বেগম। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। তাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে আনিকা তাশফিয়া আউয়াল। শ্রম মন্ত্রণালয়ে সহকারি পরিচালক তিনি। তার স্বামী কাজী মনির উদ্দিন পেশায় একজন টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশলী। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে স্যাইয়ারা তাশফিয়া আউয়াল ও তার স্বামী জাকিউল হক। দুজনেই ব্যারিস্টার।

ড. এএমএম আনিসুল আউয়াল ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। তিনি এমবিএতে ভালো ফলের জন্য চ্যান্সেলর স্বর্নপদক পেয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অব হেলথের (এফআরএসএইচ) ফেলোশিপ লাভ করেন। ২০০৯ সালে তিনি এফসিজিপি সম্পন্ন করেন। ২০১২ সালে তিনি অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবারো এমবিএ করেন।
গান শোনা, গান গাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, এবং বেড়ানো তার পছন্দের কাজগুলোর অন্যতম।